এটা পৃথিবীর সবথেকে ফাঁকা জায়গাগুলোর মধ্যে একটা। এটা একটা মরুভূমি, যেখানে একটাও মানুষ থাকে না বললেই চলে। কিন্তু এই জায়গাতেই চলছে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং মার্ভেলের কনস্ট্রাকশন। চিলি দেশের অ্যাটাকামা মরুভূমিতে ইঞ্জিনিয়াররা পৃথিবীর সবথেকে বড় টেলিস্কোপ তৈরি করছে, যা সমস্ত রেকর্ড ব্রেক করে দেওয়ার মতো। এই টেলিস্কোপটা এমন এক জায়গায় তৈরি হচ্ছে, যেখানে নরমাল পৃথিবীর সঙ্গে এর কোনো কন্টাক্ট নেই। এই টেলিস্কোপ মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের চিন্তা ভাবনাকে আরো বিস্তৃত করবে। এমনকি হয়তো অন্যান্য গ্রহে জীবন আছে কিনা তার সন্ধানও খুঁজে পাবে।
আজকে এই ARTICLE আমরা ইএলটি অর্থাৎ এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ সম্পর্কে জানবো। জানবো কিভাবে এটা তৈরি হচ্ছে এবং তৈরি হবার পর এটা কি কি কাজ করতে পারবে। টেলিস্কোপটাকে তৈরি করা হচ্ছে চেরো আরমাজোনেস নামক একটা পাহাড়ের উপরে, প্রায় 3000 মিটার উঁচু। এই প্লাটফর্মটা চিলি দেশের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত, যেখান থেকে দেশের রাজধানী স্যান্টিয়াগো প্রায় 1300 কিলোমিটার দূরে। এই সাইটটার সবচেয়ে কাছের যে টাউনটা আছে, তার নাম হলো টালটা। তবে সেটাও এই জায়গা থেকে প্রায় 30 কিমি দূরে।
সাইটের কাছ পর্যন্ত যেতে গেলে একটাকামা মরুভূমিকে পার করে যেতে হবে, যা পৃথিবীর কয়েকটা সবথেকে শুকনো এলাকার মধ্যে একটা। এই এলাকাটাকে দেখলে কখনো মনে হবে আপনি চাঁদে চলে এসেছেন, আবার কখনো মনে হতে পারে আপনি মঙ্গল গ্রহের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। যতদূর চোখ যাবে, এই বিস্তীর্ণ মরুভূমি ছড়িয়ে আছে একেবারে সীমানা পর্যন্ত।
তবে পৃথিবীতে এত জায়গা থাকা সত্ত্বেও তারা এই অ্যাটাকামা মরুভূমিকেই কেন বেছে নিল তাদের কাজের জন্য? শুধুমাত্র অন্য গ্রহের সঙ্গে সিমিলারিটি থাকার জন্যই এই জায়গাটাকে চুজ করা হয়নি, বরং জায়গাটাকে চুজ করা হয়েছে এর ইনহস্পিটেবল কন্ডিশনের জন্য। মানে এমন একটা জায়গা যেখানে জীবজন্তু, পশুপাখি তাদের নরমাল লাইফ কাটাতে পারে না। এখানে বৃষ্টিপাত খুবই রেয়ার, মানে এখানে বৃষ্টি হলে সেটাকে ব্যতিক্রমী ঘটনা বলে মনে করা হয়। আর এই কারণের জন্যই প্রতিবছর 320 টা আবিষ্কার রাত এখানে দেখা যায়।
এবার যেহেতু খুব কাছের শহরও এখান থেকে 30 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, অর্থাৎ আশেপাশে মানুষের কোন জনবসতি নেই, তাই এখানে লাইট পলিউশনও খুবই কম। পৃথিবী থেকে টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাকাশকে দেখতে গেলে একটা সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় আমাদের কাছে সেটা হলো লাইট পলিউশন। রাতের আকাশ যদি একেবারে অন্ধকার থাকে, তাহলেই টেলিস্কোপের সাহায্যে খুব ভালোভাবে পরিষ্কারভাবে মহাকাশকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। আর এটাও একটা বড় কারণ এই জায়গাটাকে চুজ করার পেছনে।
তবে এই এলাকাটাকে যে বৈজ্ঞানিকরা প্রথম আবিষ্কার করেছে এমনটা নয়। এখান থেকে মাত্র 20 কিমি দূরে ভেরি লার্জ টেলিস্কোপকে ডেপ্লয় করা হয়েছে অনেকদিন আগেই। বর্তমানে ভিজিবল লাইট স্পেক্ট্রামের মধ্যে ভিএলটি অর্থাৎ ভেরি লার্জ টেলিস্কোপকে সবথেকে পাওয়ারফুল মনে করা হয়। তবে একে ওভারটেক করে দেবে ইএলটি যখন এটা চালু হবে। অ্যাস্ট্রোনোমারদের কাছে চিলি সবসময় ফার্স্ট চয়েস হয়ে এসেছে, কারণ পৃথিবীর প্রায় 70% আর্থ অবজারভেটরি এই দেশেতেই উপস্থিত।
ভিএলটি এবং ইএলটি দুটোরই মালিক হলো ইউরোপিয়ান সাদান অবজারভেটরি। এই ইন্টারগর্মেন্টাল অর্গানাইজেশনটা 1962 তে স্থাপিত হয়েছিল। এই সংস্থার মধ্যে আছে 16 টা ইউরোপের দেশ। তবে ইউরোপের বাইরেও দুটো দেশ এই সংস্থার সঙ্গে জড়িত, একটা হলো অস্ট্রেলিয়া এবং দ্বিতীয়টা আপনি ঠিকই গেস করেছেন, চিলি। এই সংস্থার প্রায় 65% বাজেট জার্মানি, ফ্রান্স, ইউকে এবং ইটালি থেকে আসে। এই অর্গানাইজেশনের মেইন কাজ হলো গ্রাউন্ড বেসড অবজারভেটরি তৈরি করা এবং সেগুলোকে অপারেট করা। এদের রিসার্চের জন্য বড় বড় ব্রেক থ্রুও পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে সবথেকে আইকনিক হলো 2022 এ এই অর্গানাইজেশনই প্রথম ব্ল্যাক হোলের ছবি সবার সামনে তুলে ধরেছিল।
তবে এই ডিসকভারির পরে তারা থেমে যায়নি। বরং তারা আরো বড় এবং পাওয়ারফুল অবজারভেটরি তৈরি করার কাজে লেগে গেছে। ইএলটি অর্থাৎ এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপকে বানানোর সিদ্ধান্ত তারা 2010 এ নিয়েছিল। প্রথমদিকে তারা মনে করেছিল 2018 এর মধ্যে তারা কাজ কমপ্লিট করে ফেলতে পারবে এবং সবকিছু ঠিক থাকলে 2028 এর মধ্যে অবজারভেটরিটা ফুললি ফাংশনাল হয়ে যাবে। বর্তমান রিপোর্ট অনুযায়ী এই অবজারভেটরির কাজ প্রায় অর্ধেকের বেশি কমপ্লিট হয়ে গেছে। তবে তারা কাজে কোন দিক থেকে কোন খামতি রাখতে চায় না, তাই এই অবজারভেটরিটাকে তৈরি করার বাজেট প্রায় 1.5 বিলিয়ন ইউরো হতে চলেছে।
ভাষ্যকর ব্যাপার হলো এই অবজারভেটরির কাজ কোন শিলান্যাস করে হয়নি, বরং এক্সপ্লোসিভের বিস্ফোরণের মাধ্যমে হয়েছিল। অবজারভেটরিটাকে ওই পাহাড়ের উপরে স্থাপন করার জন্য পাহাড়ের চূড়াটাকে সবার প্রথমে ফ্ল্যাট করার দরকার ছিল, যে কাজটা 2014 তে শুরু হয়। পাহাড়ের উপর থেকে প্রায় 2 লক্ষ 22000 কিউবিক মিটার পাথর সরাতে হয়। পাহাড়ের চূড়াটা সমতল হয়ে যাওয়ার পর অবজারভেটরির বিশাল ভিত তৈরি করা হয়। তারপর থেকে 160 থেকে 220 জন ওয়ার্কার প্রতিদিন এখানে কাজ করে চলেছে। যেহেতু এখানকার বাতাসের আদ্রতা খুবই কম, তাই ওয়ার্কারদের কন্টিনিউয়াসলি জল পান করে যেতে হয়। তার সাথে ভূপৃষ্ঠ থেকে এর এলিভেশন অনেকটা উপরে থাকার জন্য ইউভি রেডিয়েশনের ভয়ও থাকে, তাই তাদের ড্রেসও সেই মতোই পড়তে হয়।
বর্তমানে এই ইঞ্জিনিয়ারিং মাস্টারপিসের কঙ্কাল তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রায় 80 মিটার চওড়া এবং 80 মিটার উঁচু। একটা এক্সাম্পল এর জন্য আমেরিকার স্ট্যাচু অফ লিবার্টির উচ্চতা প্রায় 93 মিটার। সুতরাং ওই স্ট্যাচু অফ লিবার্টিটা প্রায় প্রায় ওই স্কোপের মধ্যে ফিট হয়ে যেতে পারে। আর শুধু তাই নয়, আরো কিছু নাম্বার এবং ফিগার আছে যেগুলো আপনাকে অবাক করতে পারে। অবজার্ভেটরির ডোমটার ওজন প্রায় 6100 মেট্রিক টন। ডোমের উপরে লাগানো আছে দুটো দরজা, যেগুলো দরকার মতো খুলবে আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারবে। তাদের প্রত্যেকটার ওজন প্রায় 400 টন করে। আর পুরো সিস্টেমটা বসানো থাকবে একটা 360 ডিগ্রি স্লাইড সিস্টেমের উপর, যাতে অ্যাস্ট্রোনমাররা আকাশের যেকোনো জায়গায় পয়েন্ট করতে পারে তাদের টেলিস্কোপকে।
তার সাথে এই অবজারভেটরির ইলেকট্রিক সাপ্লাই এর জন্য এখানে একটা সোলার পার্কও তৈরি করা হয়েছে, অর্থাৎ পুরো সিস্টেমটা চলবে সোলার এনার্জি দিয়ে। এই এলাকাতে ভূমিকম্পের প্রভাবও দেখা যায়, তাই সাইজমিক অ্যাক্টিভিটি থেকে বাঁচার জন্য এই স্ট্রাকচারের মধ্যে ডাবল সাইজমিক সিস্টেম লাগানো আছে, যার মধ্যে হাইড্রলিক জ্যাক্স এবং ড্যাম্পার লাগানো আছে, যাকে স্পেশালি এই টেলিস্কোপের জন্যই বানানো হয়েছে।
তবে এর সাথেই আরো একটা বিপদকে তাদের মাথার মধ্যে রাখতে হয়েছে। যেহেতু এলাকাটা একেবারে রিমোট জায়গায় অবস্থিত, তাই কোন কারণে যদি আগুন লেগে যায়, তাহলে হেল্প খুব চট করে এই জায়গা পর্যন্ত পৌঁছাবে না। তাই আগুন থেকে বাঁচার জন্য এদের নিজেদের ওয়াটার ট্যাংক লাগানো হয়েছে বেসমেন্টে। আর এই সমস্ত প্রটেকশন সিস্টেমকে বানানো হয়েছে শুধু একটা জিনিসকেই বাঁচানোর জন্য। সেটা হলো এর মধ্যে লাগানো ওই টেলিস্কোপটাকে, যার মধ্যে লাগানো থাকবে পাঁচটা বিশাল বিশাল মিরার, যা লাইটকে ক্যাপচার করবে এবং বৈজ্ঞানিকদের ইন্সট্রুমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। এর মধ্যে যে প্রাইমারি মিরারটা লাগানো আছে তার ডায়ামিটার 13.9 মিটার, মানে প্রায় 128 ফিট। যা বর্তমানে ব্যবহৃত টেলিস্কোপগুলোর মিরারের থেকে অনেক অনেক বেশি বড়। এমনকি মহাকাশেও এর জুড়ি মেলা ভার। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ, যা সবথেকে বড় স্পেস টেলিস্কোপ, তার মিরারের সাইজ মাত্র 6.5 মিটার।
এই ইএলটি টেলিস্কোপটা মানুষের চোখের থেকে প্রায় 100 মিলিয়ন গুণ বেশি আলোকে ক্যাপচার করতে পারবে। এমনকি 10 থেকে 15 গুণ বেশি লাইট ক্যাপচার করতে পারবে ভিএলটির থেকে। আর একটা টেলিস্কোপ যত বেশি লাইট কালেক্ট করতে পারবে, সে তত দূরের এবং তত মৃদু বস্তুকেও দেখতে পারবে মহাকাশের মধ্যে। এজন্য সারা পৃথিবী জুড়ে বৈজ্ঞানিকরা এর অপারেশনাল হওয়ার অপেক্ষা করছে, কারণ তারা জানে যে এটা হয়তো তাদের চোখ হবে মহাকাশে।
অনেকেই এটাকে একটা টাইম মেশিনও বলছে, কারণ আলোর গতির বৈশিষ্ট্য আমরা জানি। মানে কোথাও আলো জ্বললে সেটা সাথে সাথেই আমাদের চোখে আসে না, আলোরও আসতে সময় লাগে। এক্সাম্পল হিসেবে সূর্য থেকে পৃথিবী পর্যন্ত আলো আসতে মোটামুটি আট মিনিটের মতো সময় লাগে। মানে যখন আপনি সূর্যাস্ত দেখেন, তখন আপনি দেখেন আট মিনিট আগে সূর্য কি পজিশনে ছিল। মহাকাশের ক্ষেত্রে যখন আমরা দূর-দূরান্তে দেখি, তখন এই সময়টা অনেক অনেক বেশি হয়ে যায়। এই টেলিস্কোপের সাহায্যে আমরা মহাকাশ অতীতে কেমন ছিল সেটা দেখতে পারবো। এমনকি কোন গ্যালাক্সির জন্ম হওয়াটাকেও হয়তো এই টেলিস্কোপ ক্যাপচার করতে পারবে।
ভিএলটি আমাদের দেখিয়েছিল ব্ল্যাক হোল কেমন হয়। আর ইএলটি তার থেকেও অনেক অনেক বড় টেলিস্কোপ, তাই এটা দেখার বিষয় যে এই অবজারভেটরিটা যখন শুরু হয়ে যাবে, তখন এর থেকে নতুন নতুন কি আবিষ্কার আমরা দেখতে পাবো।
তো বন্ধুরা আজকে এই পর্যন্তই যদি ভালো লাগে তবে অন্যদের সঙ্গে SHARE & COMMENT করে জানাবেন। অসংখ্য ধন্যবাদ আজকে এই পর্যন্তই আবার দেখা হবে পরের ARTICLE এ ।